অরক্ষিত সীমান্ত দিয়ে বিনা বাধায় আসছে মাদক ও অস্ত্র

আবুল খায়ের, পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে •

পার্বত্যাঞ্চলের সীমান্তে ২০ কিলোমিটার সড়ক অপরাধের প্রবেশদ্বারে পরিণত হয়েছে। এই পথ দিয়ে অবাধে আসছে বিপুল পরিমাণ অস্ত্র, গ্রেনেড, একে-৪৭ রাইফেল, গোলাবারুদ আর আগ্নেয়াস্ত্রের চালান। একই সঙ্গে ইয়াবাসহ বিভিন্ন মাদকের চালানও আসছে।

আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী সেখানে নিয়মিত টহল দিতে পারে না বিধায় অনেকটা বিনা বাধায় ঢুকে পড়ছে অস্ত্র ও মাদক। আর এসব অস্ত্র পাহাড়ের পাঁচটি সংগঠন জেএসএসএস মূল, জেএসএস সংস্কার, ইউপিডিএফ মূল, ইউপিডিএফ সংস্কার ও এমএলপির কাছে যাচ্ছে। একই সঙ্গে তা সারা দেশে সন্ত্রাসী ও জঙ্গির হাতেও পৌঁছে যাচ্ছে।

বিগত সাত বছরে পাহাড়ে পাঁচ সংগঠনের মধ্যে আধিপত্য বিস্তার ও চাঁদাবাজিসহ সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের প্রেক্ষিতে ৩৭৬ জন নিহত ও ৯৭৪ জন আহত হয়েছেন। অপহরণ হয়েছেন ৫৩৭ জন। এই সাত বছরে গুলি বিনিময়ের ঘটনা ঘটেছে ২১৭ বার। উপজাতি সন্ত্রাসী গ্রেফতার হয়েছেন ১৫৯৬ জন। ৬২২ গোলাবারুদ এবং ১০ হাজার ১০১টি অ্যামো উদ্ধার করা হয়েছে। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী ও প্রশাসন সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।

তিন পার্বত্য জেলা বান্দরবান, রাঙ্গামাটি ও খাগড়াছড়িতে এখনো কমেনি সন্ত্রাসীদের অস্ত্রের ঝনঝনানি। সশস্ত্র সন্ত্রাসীদের লাগামহীন খুন, গুম, অপহরণ ও চাঁদাবাজির কারণে নিরাপত্তাহীন পাহাড়ে বসবাসরত সাধারণ মানুষ। সরকার পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়নে আন্তরিক হলেও অবৈধ অস্ত্রধারীদের কারণে তা অগ্রসর হতে পারছে না। পার্বত্য জেলাগুলোর দুর্গম উপজেলাগুলোয় এখন অস্ত্রের মহড়া চলছে। ভয়ে কেউ মুখ খুলছে না। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের পক্ষেও এসব দুর্গম এলাকায় যাওয়া সম্ভব নয়। বিশেষ করে সীমান্তবর্তী ২০ কিলোমিটার রাস্তা অনেকটাই অরক্ষিত। এটা দেশের জন্য চরম ঝুঁকিপূর্ণ।

রাঙ্গামাটি পুলিশ সুপার (এসপি) আলমগীর কবির বলেন, বর্তমান সরকারের সময় পার্বত্যাঞ্চলে যথেষ্ট উন্নয়ন হয়েছে। সরকার উন্নয়ন কাজ অব্যাহত রেখেছে। পার্বত্যাঞ্চলের সীমান্তে অনেক অরক্ষিত এলাকা রয়েছে। এসব অরক্ষিত এলাকায় রাস্তাঘাট হলেই কাঙ্ক্ষিত ফলাফল আসবে বলে তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করেন। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী সূত্রে বলা হয়েছে, অরক্ষিত এলাকায় যদি কোন ঘটনা ঘটে তাহলে সেই সংবাদ দ্রুত পাওয়া যায় না। দুই একদিন পর সংবাদ পাওয়া যায়। আর ঘটনাস্থলে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর যেতে একদিন এবং আসতে একদিন লাগে। কোন গাড়ি সেখানে যায় না। একমাত্র হেঁটেই সেখানে যেতে হয়। আর আসা-যাওয়া মিলে দুই দিনের খাবারসহ প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র সঙ্গে করে নিতে যেতে হয়। এ কারণে সন্ত্রাসীরা সেখানে অহরহ সেখানে ঘটনা ঘটায়।

পার্বত্যাঞ্চলে আঞ্চলিক সংগঠনগুলোর অভ্যন্তরীণ কোন্দল ও আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে প্রায়ই ঘটছে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ। জানা গেছে, ২০১৪ সাল থেকে চলতি বছরের অক্টোবর পর্যন্ত পার্বত্য চট্টগ্রামে আঞ্চলিক সংগঠনগুলোর অভ্যন্তরীণ কোন্দল ও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে ২৫৬ জন উপজাতি ও ১২০ জন বাঙালি নিহত হন। এরমধ্যে ২০১৪ সালে ৪০ উপজাতি ও ১৪ বাঙালি, ২০১৫ সালে ৩৫ উপজাতি ও ৩৪ বাঙালি, ২০১৬ সালে ১৭ উপজাতি ও ২৪ বাঙালি, ২০১৭ সালে ২১ উপজাতি ও ১২ বাঙালি, ২০১৮ সালে ৫১ উপজাতি ও ১৩ বাঙালি, ২০১৯ সালে ৪৯ উপজাতি ও ১৪ বাঙালি এবং ২০২০ সালের অক্টোবর পর্যন্ত ৪৩ উপজাতি ও ৯ বাঙালি নিহত হন। ২০১৪ সাল থেকে চলতি বছরের অক্টোবর পর্যন্ত ৩০১ জন উপজাতি ও ৬৭৩ জন বাঙালি আহত হন। এরমধ্যে ২০১৪ সালে ৫৯ উপজাতি ও ৭২ বাঙালি, ২০১৫ সালে ৭০ উপজাতি ও ১৯৯ বাঙালি, ২০১৫ সালে ৪৮ উপজাতি ও ১৪০ বাঙালি, ২০১৭ সালে ৩৬ উপজাতি ও ১৩৬ বাঙালি, ২০১৮ সালে ৪৯ উপজাতি ও ২৫ বাঙালি, ২০১৯ সালে ২৩ উপজাতি ও ৫৬ বাঙালি, ২০২০ সালের অক্টোবর পর্যন্ত ১৬ উপজাতি ও ৪৫ বাঙালি আহত হন। ২০১৪ সালে ৩৭ জন, ২০১৫ সালে ৩০ জন, ২০১৬ সারে ৫২ জন, ২০১৭ সালে ১৭ জন, ২০১৮ সালে ১৪ জন, ২০১৯ সালে ১৫ জন এবং ২০২০ সালের অক্টোবর পর্যন্ত ৪ জন পার্বত্যাঞ্চলে অপহরণ হয়েছেন।